তথ্য প্রযুক্তি

এমএলএম এমটিএফই বন্ধ, বাংলাদেশ থেকে চলে গেলো কয়েক হাজার কোটি টাকা

MLM MTFE closed, tens of thousands of crores of rupees left Bangladesh

আবারও এমএলএম কোম্পানির প্রতারণায় জড়িয়ে সর্বস্বান্ত হলো দেশের লক্ষাধিক যুবক। হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেছে অবৈধ অনলাইন গ্যাম্বলিং ক্রিপ্টো ট্রেডিং করা এমএলএম কোম্পানি এমটিএফই।

ধারণা করা হচ্ছে, এই কোম্পানির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ক্রিপ্টো কারেন্সির মাধ্যমে বাংলাদেশি মুদ্রায় অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকাপাচার হয়েছে। একইসঙ্গে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার স্বপ্নে বিদেশি এই অ্যাপসের ফাঁদে অনলাইনে বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হয়েছেন হাজারও মানুষ।

দুবাই ভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম পঞ্জি মডেলে ব্যবসা করতো। ভারত ও বাংলাদেশ থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিনিয়োগকারী ছিল। তবে অধিকাংশই বাংলাদেশি বিনিয়োগকারী বলে অভিমত সাইবার বিশ্লেষকদের।

শুক্রবার (১৮ আগস্ট) রাতে বিষয়টি নিশ্চিত করেন একাধিক বিনিয়োগকারী। রাজধানীর রামপুরার দেড় লাখ ডলার খোয়ানো মাহবুব আলম বলেন, তিনি প্রায় দুই বছর ধরে এই কোম্পানির সঙ্গে আছেন। তিনি জানান, বাংলাদেশে সিইও পদমর্যাদার ব্যক্তি রয়েছেন ৪০০ জনের অধিক। শুধু রাজধানীতেই এই সিইওদের আড়াইশ অফিস উদ্বোধন হয়েছে। আর সিইও হওয়ার তালিকায় রয়েছেন আরও এক হাজার ব্যক্তি। তিনি বলেন, একেকজন সিইও এর অধীনে রয়েছেন অন্তত ১০০ থেকে ১৫০ জন। মাহবুব আলম নিজেও একজন সিইও উল্লেখ করে বলেন, ৯৩০ ডলার বা ১ লাখ ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে মাসে ৪৫ হাজার টাকা লাভ দিতো কোম্পানি। ৫০০ ডলার বা ৬০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে ২২ হাজার টাকা লাভ দিতো। এছাড়া কেউ যদি ৩ হাজার ৫০০ ডলার বিনিয়োগ করে এবং ১৫ জন ব্যক্তিকে কোম্পানিতে যুক্ত করে আর এই ১৫ জন মিলে যদি ৯ হাজার ডলার বিনিয়োগ করে তাহলে ৩ হাজার ৫০০ ডলার বিনিয়োগ করা ব্যক্তি প্রতি মাসে অন্তত ৪ লাখ টাকা করে লাভ পেয়ে থাকে। এভাবেই শত শত যুবককে কোটিপতি বানিয়েছে এই কোম্পানি। তবে হঠাৎ করে কোম্পানিটি উধাও হয়ে যাবে তিনি তা বিশ্বাস করতে পারছেন না। যদিও গত ১৫ দিন যাবত টেকনিক্যাল প্রব্লেম বলে এই কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের কমিশন বন্ধ রেখেছিল। এখানে যারা টাকা দিচ্ছিলেন তারা আর টাকা উঠাতে পারছিলেন না। বৃহস্পতিবার থেকে আর কোনও লেনদেন হচ্ছে না। শুক্রবার পুরোপুরিভাবে এমটিএফই তাদের সিস্টেম বন্ধ করে দিয়েছে।

কমপক্ষে ৫০০ ডলার বিনিয়োগ করলে দিন শেষে পাঁচ হাজার টাকা লাভ আসবে। এই কল্পিত মুনাফার লোভে শত শত মানুষ বিনিয়োগ করেছিলেন। অনেকে গয়না এবং মূল্যবান সামগ্রী বন্ধক রেখেও বিনিয়োগ করেছিলেন।

এক মাস আগে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করা যুবক কালাম বলেন, আক্তার নামের এক ব্যক্তির কথায় বিশ্বাস করে আমি এই অ্যাপসে টাকা বিনিয়োগ করি। আমি প্রতিদিন মুনাফা দেখছিলাম, কিন্তু এখন পর্যন্ত এক টাকাও তুলতে পারিনি। এর আগেই কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে।

ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফেসবুকের নিউজ ফিডে বিভিন্ন বিদেশি অ্যাপসের লোভনীয় মুনাফার বিজ্ঞাপন প্রচারের পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে অনলাইন প্রচার চালায় কিছু যুবক। এই অ্যাপসের একাধিক হেল্প অফিসও খোলা হয়েছে রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে।

জানা গেছে, অ্যাপের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং বা বাইন্যানসের মাধ্যমে তারা টাকা নিতো। পরে স্থানীয় এজেন্টরা সেটি বাইরে পাচার করতো। বাংলাদেশে এসএসসি এবং এইচএসসি পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মুনাফার লোভ দেখিয়ে টার্গেট করা হতো।

সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য ‌এই কম্পানির লেনদেন বা ট্রেড হতো সপ্তাহে ৫ দিন বাংলাদেশি সময় রাত ৭ থেকে রাত ১টা পর্যন্ত। সোমবার থেকে শুক্রবার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ট্রেড হলেও সিইওদের জন্য লেনদেন হতো শনিবারসহ সপ্তাহে ৬ দিন। রবিবার বন্ধ থাকতো।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী এমএলএম ব্যবসা পরিচালনা এবং ক্রিপ্টো কারেন্সিতে লেনদেন অবৈধ এবং নিষিদ্ধ।

এর আগে গত ১০ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, অবৈধ অনলাইন গ্যাম্বলিং, গেমিং, বেটিং, ফরেক্স এবং ক্রিপ্টো ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে দেশ থেকে অর্থপাচার হচ্ছে। আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার এক বৈঠকে এই চিত্র উঠে আসে।

বৈঠকে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ পুলিশের সিআইডি, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রান্সন্যাশনাল অ্যান্ড সাইবার ক্রাইম বিভাগ এবং গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বিএফআইইউ প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাসের সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কার্যালয়ে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বলা হয়, ‌অবৈধ অনলাইন গ্যাম্বলিং, গেমিং, বেটিং, ফরেক্স এবং ক্রিপ্টো ট্রেডিং বেড়ে যাওয়ায় প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে বাংলাদেশ। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগে রয়েছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সঙ্গে বসে একযোগে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

হুন্ডি, অনলাইন গ্যাম্বলিং, গেমিং, বেটিং, ফরেক্স এবং ক্রিপ্টো ট্রেডিং প্রতিরোধে জিরো টলারেন্সে সরকার উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, আর্থিক খাতে ডিজিটাল পেমেন্ট এবং স্মার্ট পেমেন্টের প্রয়োগ বেড়েছে, যার সুফল ভোগ করছে পুরো বাংলাদেশ। তবে সুফল ও সমৃদ্ধির পাশাপাশি এসব ব্যাংকিং ও পেমেন্ট সিস্টেমের অপব্যবহারও বেড়েছে। এর মধ্যে অবৈধ অনলাইন গ্যাম্বলিং, গেমিং, বেটিং, ফরেক্স এবং ক্রিপ্টো ট্রেডিং অন্যতম।

সম্প্রতি এসব অপরাধের মাধ্যমে সংঘটিত অবৈধ লেনদেন মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছে। ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমকে কাজে লাগিয়ে এসব অপরাধ হুন্ডি প্রক্রিয়াকে সহজ ও ত্বরান্বিত করছে। এর ফলে মুদ্রাপাচার বেড়ে যাচ্ছে এবং দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশ প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে।

এতে বলা হয়, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কার্যে অর্থায়ন প্রতিরোধে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সংস্থা হিসেবে বিএফআইইউ হুন্ডি তথা অনলাইন গ্যাম্বলিং, গেমিং, বেটিং, ফরেক্স এবং ক্রিপ্টো ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে অর্থপাচার রোধসহ সব ধরনের অর্থপাচার রোধকল্পে বিএফআইইউ অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।

সম্প্রতি টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে অনলাইন বেটিং ও গ্যাম্বলিং সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

সভায় বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাস এসব অবৈধ মাধ্যমে মুদ্রাপাচার, সামাজিক অবক্ষয় ও যুবসমাজের জন্য ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরেন এবং এ ধরনের অপকর্মে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে সব সংস্থাকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান।

বৈঠকে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করবে বলে জানায় বিএফআইইউ। এ সময় সংস্থাগুলো আগামীতে এসব অবৈধ মাধ্যম প্রতিরোধে একযোগে কাজ করার কথা জানায়।

Tags
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker