জাতীয়
ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় বিপুলসংখ্যক শিশু, চান্দিনায় শিশু শ্রমিক বৃদ্ধির হার আশঙ্কাজনক

ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় বিপুলসংখ্যক শিশু, চান্দিনায় শিশু শ্রমিক বৃদ্ধির হার আশঙ্কাজনক
কাউসার আহমেদ(চান্দিনা)প্রতিনিধি
‘স্যার, এত কষ্ট ভাল্লাগে (ভালো লাগে) না। দিন-রাত কাম করতে হয়। পড়া-ল্যাহা (লেখা) করতে খুব ইচ্ছা করে। কিন্তু বাবা কয়, আমরা গরিব মানুষ। পড়া-ল্যাহা কইরা কী অইবো। কাম-কাইজ কইরা খাইতে অইবো। এ্যার লাইগা (এর জন্য) হোটেলে কাজ করি। ‘ একদমে কথাগুলো বলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে আমির হোসেন। সে চান্দিনার একটি খাবার হোটেলে কাজ করে। তার বাড়ি উপজেলার হরিনা গ্রামে।
কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলায় শিশু শ্রমিকের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে।এখানে বিপুলসংখ্যক শিশু বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত। এদের অধিকাংশের বয়স ৮ থেকে ১৪ বছর। এতে দেখা গেছে, শিক্ষাবঞ্চিত শিশুর হারও বেড়ে চলছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, একশ্রেণির মুনাফালোভীরা শ্রম আইন লঙ্ঘন করছেন। তারা পারিবারিক অস্বচ্ছলতার সুযোগ নিয়ে ওইসব বয়সের শিশুদের নামমাত্র পারিশ্রমিক দিয়ে বিভিন্ন কারখানা, রাজমিস্ত্রি, মোটর গ্যারেজ ও মোটরযানের হেলপার এবং ওয়েল্ডিং ওয়ার্কসপসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে খাটাচ্ছেন। বিশেষ করে চা-দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোর মালিকেরা অমানবিকভাবে খাটাচ্ছেন ওইসব শিশু শ্রমিকদের।
সরেজমিনে দেখা যায়, চান্দিনার হোটেল-রেস্তোরাঁ, কাঠের আসবাবপত্র তৈরির কারখানা, সেলুন, মুদি-মনোহারি দোকান, বিস্কুটের কারখানা, ওয়ার্কসপ এবং বিড়ির কারখানায় কাজ করছে ওইসব শিশু। আবার অনেক শিশু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রিকশা ও ভ্যানগাড়ি চালাচ্ছে। কেউ আবার বাস স্ট্যান্ডে ফেরি করে পানি, চকলেট, শসা, বুট-বাদামসহ হরেক রকম পণ্য বিক্রি করছে। আবার কেউ-কেউ গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজার এবং পৌর শহরের বিভিন্ন এলাকার অলি-গলিতে পরিত্যক্ত কাগজ, কার্টন, পানীয় দ্রব্যের খালি বোতল, লোহা-লক্কড়সহ নানা ভাঙাচোরা জিনিসপত্র কুড়িয়ে জমা দেয়। এতে প্রতিদিন তারা ৩০-৩৫ টাকা পায়। আবার অনেকে জড়িয়ে পড়ছে ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে।
আমির হোসেন (১২) জানায়, বাবা শাহজালাল রিকশাচালক। দীর্ঘদিন ধরে পেটের ব্যথা। ঠিকমত রিকশা চালাতে পারে না। লেখা-পড়া করার ইচ্ছে থাকলেও পরিবারের অভাব-অনটনের কারণে পড়াশোনা করতে পারেনি। তবে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। এখন সে একটি খাবার হোটেলে টেবিলে পানি দেওয়া আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করে।
সে আরো জানায়, প্রতিদিন ভোর সাড়ে ৫টায় ঘুম থেকে উঠে রাত ১২টা পর্যন্ত প্রায় ২০ ঘণ্টা খাটতে হয়। বিনিময়ে কোনো রকম দুইবেলা খাবার এবং দৈনিক ২০ টাকা পায়। আবার একটু এদিক-সেদিক হলে মালিক এবং ম্যানেজার মারধর করে। এ ছাড়া কোনো কিছু নষ্ট হলে বেতনের টাকা থেকে জরিমানা আদায় করে নেয় ম্যানেজার। একই কথা জানায় আমিরের সাথে কাজ করে বেলায়েত, সাদেক, রাজু ও খোরশেদ নামে এমন আরো চারজন শিশু।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চান্দিনা পৌর শহরের একটি খাবার হোটেল মালিক জানায়, সকলেরই শিশু সন্তান রয়েছে। কোনো সচেতন লোক চায় না, শিশুদের কাজে খাটাতে। কিন্তু কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী দারিদ্র্যতার সুযোগ নিয়ে শিশু শ্রমিকদের অমানবিক ভাবে খাটাচ্ছেন।
অপর একটি রেস্তোরাঁর মালিক জানান, দরিদ্র বাবা ও স্বজনেরা এসে অনেক কাকুতি-মিনতি করে বলেন, ওদের একটু কাজে লাগিয়ে দেন। কাজ শিখুক, টাকা-পয়সা তেমন দিতে হবে না। দুইবেলা খাবার পেলে কিছুটা হলেও সংসারের বোঝা কমবে। মানবিক কারণে তাদের অনুরোধ রক্ষা করতে গিয়ে মালিকদেরও কম-বেশি লোকসান গুনতে হয়। কারণ ওইসব কমবয়সীরা জিনিসপত্র নষ্ট করে বেশি।
সুশীল সমাজের সচেতন ব্যক্তিরা বলেন, সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করলেও তা সঠিকভাবে মানা হচ্ছে না। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত রয়েছে বিপুলসংখ্যক শিশু। এতে শিশু শ্রমিকের সংখ্যাও দিন-দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবে শিক্ষাবঞ্চিত ওইসব শিশুরা বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজেও জড়িয়ে পড়ছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে বখাটেদের তালিকায়। এ নিয়ে সমাজের অনেকে উদ্বিগ্ন।উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চান্দিনা প্রাথমিক পর্যায়ে মোট ২৩৭ টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। তার মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৩২ টি, ব্র্যাক পরিচালিত ২৬ টি, কিন্ডারগার্টেন ৫২ টি এবং ইবতেদায়ি ২৭ টি। গত বছরের মার্চ মাসে চান্দিনা উপজেলায় একটি জরিপের তথ্যানুযায়ী কেবলমাত্র ১৩২ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ৩২ হাজার ৭৭৮ জন। বিদ্যালয়গামী শিশুর সংখ্যা ৩২ হাজার ৭৫৫ জন। ঝরে পড়া শিশুর হার শতকরা ১ দশমিক ৮৬। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়াও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঝরে পড়ার সংখ্যা আরো বেশি।উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, সরকার প্রাথমিক স্তরে প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ারোধে শতভাগ উপবৃত্তি এবং শিক্ষানুরাগীদের উদ্যোগে মিড-ডে মিল কর্মসূচি চা





