জাতীয়তথ্য প্রযুক্তি

সফলতার এক অনন্য কাহিনী!

সফলতার এক অনন্য কাহিনী!

দেশের সফল নারী উদ্যোক্তা জনাব সেলিমা আহমাদ মেরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়েছেন বাণিজ্য বিভাগ থেকে। এখনও “মাস্টার্স ইন বিজনেস এ‍্যাডমিনিস্ট্রেশানে”র খন্ডকালীন শিক্ষক দেশের শীর্ষ এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা-২ (হোমনা- তিতাস) আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে দীর্ঘ ৪৫ বছর পর কুমিল্লা-২ (হোমনা-তিতাস) আসনটি পুনরুদ্ধার করেছেন তিনি।

উল্লেখ্য, দেশের স্বাধীনতার পর এ‍্যাডভোকেট মোজাফফর আলী নৌকা প্রতীক নিয়ে ১৯৭৩ সালে এ আসন থেকে একবার নির্বাচিত হয়েছিলেন। তারপর আওয়ামী লীগ আর এ আসনটি ধরে রাখতে পারেনি। ৭৩ পরবর্তী ১০টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ৬ বার, জাতীয় পার্টি এককভাবে ২ বার ও মহাজোট থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একবারসহ মোট ৩ বার নির্বাচিত হয়েছিলো। অতঃপর সেলিমা আহমাদ মেরী আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে গত নির্বাচনে আসনটিতে জিতেছেন।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনে সেলিমা আহমাদ মেরী নৌকা প্রতীকে ভোট পেয়েছিলেন ২ লাখ ৬ হাজার ৭ ভোট এবং তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ধানের শীষ প্রতীকে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন পেয়েছিলেন ২০ হাজার ৯২৬ ভোট। সেলিমা আহমাদ মেরী এক লাখ পঁচাশি হাজার একাশি ভোটের বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করেন।

সেই নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা আছে। কিন্তু লড়াইটা কার সাথে তা-ও বিবেচনায় নিতে হবে। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের প্রথম ৩ জনের একজনের সাথে। আর তার প্রতিদ্বন্দ্বি কোন যা-তা ব‍্যক্তি ছিলেন না। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে বরাবরই একজন ফাইটার হিসেবে দেখেছি সেই ৮৬ সাল থেকে। কারচুপি করে ড. মোশাররফের মতো ঝানু প্লেয়ারের পিঠ মাটিতে লাগানো অসম্ভব যদি তার প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীর বিশেষ কোন যোগ্যতা না থাকে। এই অভিমত একান্তই আমার। এবং যে দেশে ১৪০ ফুট ফাঁকা পথে মাত্র ৪০ ফুট প্রশস্ত ফেরী চলতেই বারবার সেতুর খাম্বায় ধাক্কা খায়- সেই দেশে আমার অভিমত সর্বসম্মত হবে এমন আশা কস্মিনকালেও আমি করি না।

তাহলে আসুন জেনে নেই কুমিল্লা-২ আসনের এমপি সেলিমা আহমাদ মেরীর যোগ্যতা কি। তিনি গত জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীর চেয়ে যোগ্যতার মানদন্ডে কতোটুকু এগিয়ে বা পিছিয়ে। বতর্মান পরিস্থিতিতে এই আসনে তার নিজ দলের প্রতিদ্বন্দ্বি প্রতিপক্ষ আছেন। কিন্তু আমি আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকবো একারণে যে, নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা দলে থাকবেই। সকলেই ক্ষমতা চায়, দলের পদ-পদবী চায় এবং চাওয়ার অযোগ্যতার কারণে কোন দন্ডের বিধান নেই রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্রে।

জনাব সেলিমা আহমাদ মেরী বাংলাদেশের অন্যতম ব্যবসায়ী গ্রুপ নিটল-নিলয় গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান। তিনি কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন বিগত কমিটিতে এবং বতর্মান কমিটিতে অপরাপর সাংসদদের মতোই কার্যকরি সদস্য। সক্রিয় রাজনীতিতে অভিষেক ২০১৬ সালের দিকে। এর আগে বহুকাল পূর্ব থেকেই দেশের বণিক সমিতির অভিজাত সংগঠনের রাজনীতির (trade politics) সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং আছেন।

জন্ম ঢাকায় হলেও পিতৃগৃহ হোমনার আসাদপুর ইউনিয়নের পাথালিয়াকান্দি গ্রামে। মাতুলালয় তিতাসের বলরামপুর ইউনিয়নের কালাই গোবিন্দপুরের ঐতিহ্যবাহী শিকদার বাড়ি। বাবার নাম এ কে এম ফজলুল হক এবং মা রহিমা হক। বাবা মা দুজনেই গত হয়েছেন।

বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অনন্য দৃষ্টান্ত বলে গণ‍্য করা হয় জনাব সেলিমা আহমাদকে। ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল সাংবাদিক বা শিল্পী হওয়ার, কিন্তু হয়েছেন ব্যবসায়ী। সফল হয়েছেন এই পেশায়। সৃষ্টি করেছেন ইতিহাস। বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (BWCCI) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তিনি। এছাড়াও দেশের শীর্ষ ব‍্যবসায়ী সংগঠনগুলোর ফেডারেশন এফবিসিসিআই-এর পরিচালক ছিলেন। কয়েক দফা সরকার স্বীকৃত “গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ব‍্যক্তি” (CIP) মনোনীত হয়েছেন এবং এখনও তিনি CIP.

জনাব সেলিমা আহমাদ সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার আগে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব জনতা ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে তিনি সোনালী ব্যাংকের পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেছেন। ২০১৪ সালে ব্যবসায় অনন্য অবদানের জন্য তিনি নরওয়ে সরকারের “অসলো বিজনেস ফর পিস” পুরস্কার লাভ করেন। বাংলাদেশে প্রথম কোনো নারী এই পুরস্কার পেয়েছেন। এশিয়া মহাদেশে প্রথম মুসলিম নারী হিসেবেও তিনি এই পুরস্কার পান। ব্যবসার সঙ্গে সামাজিক মূল্যবোধের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে শান্তি ও স্থিতিশীলতা সৃষ্টিতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়।

তিনি “ইন্টারন্যাশনাল অ্যালায়েন্স ফর উইমেনে”র বৈশ্বিক দূত (Global Ambassador)। তার নেতৃত্বে নারী উদ‍্যোক্তাদের জন্য জামানতমুক্ত এবং স্বল্প সুদে ব‍্যাংক ঋণের সুবিধা প্রতিষ্ঠিত হয়। বতর্মানে প্রায় পঁচিশ হাজার নারী উদ‍্যোক্তা এই সুবিধার আওতায় ব‍্যবসায়ে এবং আপন মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত।

তিনি মহিলা উদ্যোক্তা অর্থ উদ্যোগের (We-Fi) নেতৃত্বের চ্যাম্পিয়নদের একজন, যাদের লক্ষ্য উঁচু স্তরের দেন-দরবারের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশ্বব্যাপী আর্থিক ও সামাজিক সমর্থন ও সহযোগিতা আদায় করা।

নিটল-নিলয় গ্রুপ বাংলাদেশের শীর্ষ স্থানীয় একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ একথা সকলেরই জানা। সেলিমা আহমাদ মেরীর স্বামী জনাব আবদুল মাতলুব আহমাদ। তিনি নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান। এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি। বর্তমানে তিনি ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (Indo-Bangla Chamber of Commerce and Industry)র সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। জন্ম ঢাকায়, ১৯৫২ সালে। অর্থনীতিতে লন্ডনের অক্সফোর্ড থেকে মাস্টার্স করেছেন। ১৯৮২ সালে ছোট একটি গ্যারেজ ভাড়া নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। এখন চিনি, সিমেন্ট, কাগজশিল্পসহ ১১টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে এই গ্রুপের মালিকানায়। জনাব আবদুল মাতলুব আহমাদ বাংলাদেশ অটোমোবাইল অ্যাসেম্বলার্স অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ইতিপূর্বে বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ছিলেন। তিনি বরাবরই একজন CIPও বটে।

আহমাদ দম্পতির দুই সন্তান আবদুল মুসাব্বির আহমেদ নিটল এবং আবদুল মারিব আহমেদ নিলয়। দুই ছেলের ডাক নামেই গ্রুপের নাম রাখা হয়েছে নিটল-নিলয় গ্রুপ।

⏩জনাব সেলিমা আহমাদ কর্তৃক প্রাপ্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারঃ

অসলো বিজনেস ফর পিস পুরস্কার – ২০১৪ সালে।
বেস্ট বিজনেস উইমেন – ২০০০, ২০০২ ও ২০০৩ সালে।

এছাড়া ২০০৭ সালের জুলাই মাসে একটি ব‍্যতিক্রমী পুরস্কারও তিনি লাভ করেছিলেন। সে পুরস্কারটির নাম- ভারতের স্বর্গীয় প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে শ্রদ্ধার সাথে চিরস্মরণীয় অকৃত্রিম বন্ধু শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে ডাকা হতো যে নামে।⬅

আমার বিশ্বাস কুমিল্লা-২ আসন এলাকার সম্মানিত পাঠকগণ জনাব সেলিমা আহমাদ মেরী সম্পর্কে এই তথ্যভিত্তিক রচনাটি থেকে তার সকল প্রতিদ্বন্দ্বিদের একটি তুলনামূলক বিচার ও বিশ্লেষণের সুযোগ পাবেন।

[সাংবাদিক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন মোল্লা। ঢাকা, ২৩ আগস্ট, ২০২১]

Close