
বাল্যবিবাহ ও আমাদের দায়বদ্ধতা
সকালে ঘুম ভাঙলেই পত্রিকার খোঁজ করি। পত্রিকায় চোখ না বুলিয়ে সাধারণত বাহিরে যাওয়া হয় না। প্রতনিয়ত খুন ধর্ষণের পাশাপাশি বেড়েই চলেছে বাল্য বিবাহ। বাল্য বিবাহ রোধ করতে এত এত প্রচারণার পরও বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে অহরহ ঘটছে এমন ঘটনা। স্থানীয় প্রশাসনের ওপর বিবাহ রোধের সব ক্ষমতা থাকলেও অনেকেই হয়তো ভয়ে সে পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারেন না। এক্ষেত্রে বাবা-মায়ের বক্তব্য হলো- আমার মেয়েকে আমি বিয়ে দেব তাতে কার কি আসে যায়। এই সময়ে এসে এমন বক্তব্য শুনতে পাওয়াটা বেশ কষ্টসাধ্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রত্যেকটি শিশুর শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন শিক্ষাবৃত্তি। মেয়েদের উপবৃত্তির পাশাপাশি মা’কেও দেয়া হচ্ছে শিক্ষাবৃত্তি। যেন কোনো শিশু আর অকালে শিক্ষার অভাবে ঝরে না যায়।
এই শিক্ষাবৃত্তি কি প্রকৃতভাবেই শিক্ষার পেছনে খরচ হচ্ছে নাকি দৈনন্দিন জীবনযাত্রা খরচ হচ্ছে সেটা তদারকির কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার উপকরণ না কিনে কেনা হচ্ছে জীবিকা। তাহলে উপবৃত্তির ফায়দা কি? একটি ছোট্ট মেয়ে শিক্ষিত হয়ে উঠবে, ধীরে ধীরে তার অধিকারের বিষয়ে সচেতন হবে। বাবা মায়ের ভুলে পাতা ফাঁদে পা দিবে না। এজন্যই তো নারীদের শিক্ষা গ্রহণ জরুরি বিষয়। সেটা কি আসলেই হচ্ছে? এ অবস্থার পেছনে আসলেই দায়ি কে? বাবার ভুলের খেসারত কেন একটা ছোট্ট শিশু দেবে। ভরণ পোষণের পাশাপাশি শিক্ষার উপকরণের অর্থ সরকার তো দিচ্ছে, তাহলে সীমাবদ্ধতা কোথায়?
আমাদের সমাজ থেকে বাল্য বিবাহ রোধ করা সম্ভব শুধুমাত্র বাবা-মায়ের সচেতনতা দিয়ে। তাদের বুদ্ধি বিবেচনা যতদিন না বৃদ্ধি পাবে ততদিন আমাদের সমাজ থেকে কোনো প্রকার আইন দ্বারা এই সমস্যা রোধ করা সম্ভব নয়।
সারা বাংলাদেশের অবস্থা একই। সব খানেই বাল্যবিবাহ জোরদার হচ্ছে। সম্প্রতি পাস হওয়া বাল্যবিবাহ আইন এর সফলতা কি? আর তার কাজটাই বা কি হচ্ছে? বিভিন্ন সভা-সমাবেশে মানুষকে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে। এর কুফল সম্পর্কে গ্রামবাসীকে সচেতন করতে ইউপি চেয়ারম্যানদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। কিছুদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিত না থাকলে স্কুল কর্তৃপক্ষের উচিত স্থানীয় প্রশাসনকে বিষয়টি জানানো। বা স্কুল কমিটিকে বিষয়টি অবহিত করা জরুরি তাহলেই হয়তো অনেক শিশুকে বাল্যবিবাহের কবল থেকে ছিনিয়ে আনা সম্ভব।
বাল্য বিবাহ আইনে কিছু বিষয় আরও বেশি পরিষ্কার করা জরুরি। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭-এর বিশেষ ধারায় ‘বিশেষ ক্ষেত্রে’, ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ বা ১৮ বছরের কম বয়সী কোন মেয়ের ‘সর্বোত্তম স্বার্থ’ বিবেচনায় বিয়ে হলে তা অপরাধ গণ্য হবে না বলে উল্লেখ আছে।’ কিন্তু আইনটি আরও বেশি প্রবল করার দরকার ছিল যে, ১৮ বছরের নিচে কোন মেয়ের বিয়ে হওয়া দন্ডনীয় ও মার্জনীয় অপরাধ। কিন্তু সেটা না করে সেখানে ‘বিশেষ ক্ষেত্র’ রাখা হয়েছে। সেটার সুযোগ নিঃসন্দেহে সবাই নিচ্ছে। বাল্যবিবাহ নিরোধের পুরনো আইন বিলোপ করে নতুন আইন প্রণয়নের সময় থেকে বিশেষ ধারায় অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিয়ে বৈধ করার বিষয়ে কানাঘুষা ছিল। শেষ পর্যন্ত এ বছরের মার্চে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭ বিশেষ বিধানসহ পাস হয়।
‘আইন থাকেন ঈশ্বরের ঐ ভদ্র পল্লীতে’। বিষয়টি এরকমভাবেই প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। বাল্যবিবাহের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে অষ্টম। বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচে বাল্যবিবাহের হার শূন্যের কোঠায়, ২০২১ সালের মধ্যে ১৫-১৮ বছরের বাল্যবিবাহের হারকে এক-তৃতীয়াংশে ও ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ পুরোপুরি নির্মূল করার অঙ্গীকার করেছে। প্রতিশ্রুতি পূরণের অংশ হিসেবে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯ বাতিল করা হয় এবং এর বিশেষ ধারা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের গভর্নেন্স অ্যান্ড ইনোভেশন ইউনিটের উপপরিচালক মোহাম্মদ আলী নেওয়াজের বক্তব্য হলো, বিশেষ ধারা নিয়ে তাদের ইউনিট মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে কিছু পরামর্শ দিয়েছে। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭-এর বিধিমালা প্রণয়নের জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সুপারিশ চেয়েছিল। তারা সে অনুযায়ী পরামর্শ দিয়েছেন। গভর্নেন্স অ্যান্ড ইনোভেশন ইউনিট থেকে পাঠানো সুপারিশে বলা হয়েছে, যে ধরনের অপরাধের জন্য একটি শিশু বিরূপ অবস্থার সম্মুখীন হয়, সরকার তা অনুমোদন করছে বিশেষ বিধান মানে তা নয়। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের রক্ষাকবচ দেয়া এই বিধানের উদ্দেশ্য।
সুপারিশে যা বলা আছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সুপারিশে বিশেষ বিধান প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোন শিশু ধর্ষণের শিকার হলে তার সঙ্গে ধর্ষকের বিয়ে না হওয়া নিশ্চিত করতে বলা হয়। বলা হয়, ‘যদি আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয় যে উল্লিখিত ঘটনায় দন্ডবিধির ৩৭৫ ধারার অধীনে সংঘটিত অপরাধের (ধর্ষণ) উপাদান রয়েছে, তাহলে আদালত অপ্রাপ্তবয়স্কের বিয়েতে সম্মতি দেবেন না।
প্রেমের সম্পর্কের কারণে কোন অপ্রাপ্তবয়স্ক গর্ভবতী বা সন্তানের মা হয়েছে এমন বা শিশুর আত্মীয়স্বজন, মা-বাবা, ভাইবোন, নানা-নানী কেউ জীবিত নেই এবং তার ভরণপোষণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দুঃসাধ্য হলে আদালতের সিদ্ধান্তে বিয়ে হতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রেও শর্তজুড়ে বলা হয়েছে, শিশু যদি গর্ভবতী হয়ে পড়ে তাহলে মা-বাবা বা অভিভাবককে সংশ্লিষ্ট জেলার সিভিল সার্জন বা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তার প্রত্যয়নপত্র আদালতে দেখাতে হবে। যে শিশুর অভিভাবক নেই এবং ভরণপোষণের কোন ব্যবস্থা নেই, সেই শিশুর বিয়ের সিদ্ধান্ত দেয়ার আগে আদালতে সরকারি শিশুসদন বা সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত এতিমখানা কর্তৃপক্ষকে বলতে হবে তারা শিশুটিকে রাখতে পারবে না। ‘শিশুর নিরাপত্তা দেয়া দুঃসাধ্য’ এই প্রত্যয়নপত্র সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে আদালতে পেশ করতে হবে।
বিশেষ ধারা নিয়ে হাইকোর্টে রিট করে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি। এর সাবেক নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সুপারিশকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চলগুলোর ৯০ ভাগ মানুষ বিয়ের বয়স ১৮ জানেন বলে গবেষণায় দেখা গেছে।
জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার দেশের ভাবমূর্তি বিশ্বের কাছে পরিষ্কার করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কিন্তু আমরা গাছের গোড়া কেটে মাথায় জল ঢালতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছি। আইন থাক আইনের জায়গায়, আইন কি আমার সন্তান বা আমাদের মুখে একবেলা খাবার তুলে দিচ্ছে? এরকম ভিত্তিহীন, অযৌক্তিক অজুহাত দাঁড় করিয়ে রেখেছেন আমাদের অভিভাবকরা। মেয়ে হয়েছে, মেয়ের জন্য মাকে অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হয়। কেন মেয়ে সন্তান জন্ম দিল। এভাবে মানসিক, শারীরিক নির্যাতন তো আছেই! আমাদের অঙ্গিকার হোক আর একটিও হতে দেব না বাল্যবিয়ে। শিক্ষিত হোক নারীরা। এগিয়ে যাক পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও। তাহলেই হাসবে বাংলাদেশ।





