অপরাধ
চান্দিনায় সৎ মায়ের নির্যাতনে মানসিক ভারসাম্যহীন তিথি

চান্দিনায় সৎ মায়ের নির্যাতনে মানসিক ভারসাম্যহীন তিথি
।। মো. আবদুল বাতেন।।
কুমিল্লার চান্দিনায় স্কুল শিক্ষিকা সৎ মায়ের ধারাবাহিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে তিথি (১৫) নামের এক কিশোরী।
মাতৃ স্নেহহীন তিথি বাবার সাথে সৎ মায়ের ঘরেই বসবাস তার। চলতি বছরের শুরুর দিকে বাবা অবৈধ ব্যবসার কাজে জড়িয়ে কারাগারে থাকায় চান্দিনার ভাড়া বাসার চার দেওয়ালের মাঝেই সহ্য করতে হচ্ছে সৎ মায়ের ধারাবাহিক নির্যাতন।
পাশ্ববর্তী দেবীদ্বার উপজেলার বরকামতা গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য জামাল হোসেন এর মেয়ে ইসরাত জাহান তিথি সারা গায়ে ক্ষত নিয়ে চান্দিনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছে। বিষয়টি গণমাধ্যম কর্মীদের নজরে আসার সাথে সাথেই গা ঢাকা দেয় সৎ মা মাহমুদা সুলতানা লাভলী। তিনি দেবীদ্বার উপজেলার প্রেমু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক।
এ ঘটনায় তিথি’র খালু সামছুল হক ভূইয়া বাদী হয়ে সোমবার (১২ অক্টোবর) রাত ১টায় চান্দিনা থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়- দেবীদ্বার উপজেলার বরকমতা গ্রামের বিরাম বাড়ির মৃত আরব আলীর ছেলে জামাল হোসেন (৪৫) সেনাবাহিনীতে চাকুরীরত অবস্থায় ১৯৯৬ সালে দেবীদ্বার উপজেলার জাফরাবাদ (সীমারগুড়ি) গ্রামের আমেনা খাতুন তিন্নি কে বিবাহ করেন।
দাম্পত্য জীবনে তিথি ও আবু মুছা নামে দুই সন্তান জন্ম নেওয়ার পর ২০১৫ সালে প্রথম স্ত্রী তিন্নি মারা যায়। মা মারা যাওয়ার পর তিথি ও মুছা বাড়িতে চাচির কাছে বড় হতে শুরু করে। এদিকে সেনা বাহিনী থেকে অবসর নেওয়া জামাল হোসেন ২০১৭ সালে স্কুল শিক্ষিকা লাভলীকে বিবাহ করে চান্দিনায় ভাড়া বাসায় বসবাস করে। কিন্তু সৎ মা লাভলী কোন ভাবেই মেনে নিতে পারেনি তিথি ও মুছাকে।
চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারী পিতা জামাল হোসেন পুলিশের হাতে আটক হয়ে কারাগারে থাকায় তিন্নি ও মুছা সৎ মায়ের সাথেই বসবাস করছিল। পিতার অবর্তমানে তুচ্ছ বিষয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালাতে থাকে সৎ মা লাভলী। কথায় কথায় মারধর, দেয়ালের সাথে ধাক্কা, খুন্তির ছ্যাঁকাসহ নানা শারীরিক, মানসিক ও অমানবিক নির্যাতন চলে তার উপর। চলতি মাসের ১ অক্টোবর কাজ করতে না পারার অযুহাতে তিথিকে বেধরক পিটিয়ে গায়ে খুন্তি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছ্যাঁকা দেয়। এতে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে দেবীদ্বার উপজেলার বাগমারা ইসলামীয়া আলিম মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া তিথি।
গত ২ অক্টোবর খালু সামছুল হক ভূইয়া এসে চান্দিনার রূপনগরের ভাড়া বাসা থেকে তিথিকে নিয়ে যান ময়নামতি সেনা নিবাস সংলগ্ন ঘোষনগর উদয়নবাগ এলাকার নিজ বাসায়। সেখানে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা করান খালু সামছুল হক। কিন্তু তখনও তিনি জানতেন না তিথির সারা শরীরে ক্ষত! মানসিক ভারসাম্যহীন থাকায় তিথিও কিছু বলতে পারছিল না। গত ১২ অক্টোবর তিথি বাথরুমে গোসল করার সময় খালাতো বোনের চোখে পড়ে তার সারা শরীরের ক্ষতের চিহ্ন। ওই বিষয়ে স্থানীয় কোন এক ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিথির সারা শরীরের ক্ষত-বিক্ষতের ছবিযুক্ত ‘সৎ মায়ের নির্যাতনের শিকার তিথি’ শিরোনামে একটি লিখা আপলোড করলে গণমাধ্যম কর্মীদের নজরে আসে। সোমবার রাতেই গণমাধ্যম কর্মীরা খোঁজ নিয়ে ময়নামতি ঘোষনগর খালুর বাসা থেকে তিথির সাথে কথা বলে চান্দিনার বাসায় আসে।
এদিকে খবর পেয়ে রাত সাড়ে এগারোটার দিকে বুড়িচং থানার দেবপুর পুলিশ ফাঁড়ি ইনচার্জ ইন্সপেক্টর আজিজুল ইসলাম তিথিকে উদ্ধার করে বর্তমান ঠিকানা অনুযায়ী চান্দিনা থানায় নিয়ে যান।
এদিকে তিথির খালাতো ভাই নাছিমুল হাসান ভুইয়া বলেন, তিথিকে এভাবে নির্যাতন করা হয়েছে তা জানতাম না। আমরা তিথিকে আমাদের বাসায় আনার পর আমরা বিষয়টা জানতে পারি।
তিথির চাচী বরকামতা জাগরনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রওশন আরা আক্তার জানান- তিথি ছোট বেলা থেকে খুব মেধাবী ছাত্রী ছিল। পড়াখেলার পাশাপাশি খেলাধুলা ও নাচ-গাণেও বেশি পারদর্শী ছিল। একাধিকবার উপজেলা পর্যায়ে পুরস্কৃত হয়। আমার কাছে থাকা অবস্থায়ও সে সুস্থ ছিল। কিন্তু গত ৮-৯ মাসের নির্যাতনে সে সম্পূর্ণ মানসিন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।
এই অমানবিক ঘটনার সাথে জড়িত শিক্ষক লাভলীকে দ্রুত আইনের আওতার এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী জানিয়েছেন তিথির স্বজন ও প্রতিবেশীরা।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত সৎ মা মাহমুদা সুলতানা লাভলী পলাতক থাকায় তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
চান্দিনা থানার ওসি শামসউদ্দিন মোহাম্মদ ইলিয়াছ জানান- আহত তিথিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এ ঘটনায় শিশু নির্যাতন দমন আইনে চান্দিনা থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তিথির সৎ মা-কে গ্রেপ্তার করতে তাদের চান্দিনার বাসায় অভিযান চালালে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে সে পালিয়ে যায়। আসামি গ্রেপ্তারে পুলিশ কাজ করছে বলে জানিয়েছেন তিনি।