তথ্য প্রযুক্তি

“কাঠের পুলের গল্প”নুরুল ইসলাম উপসহকারী পরিচালক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), চট্টগ্রাম।

“কাঠের পুলের গল্প”

কোন রকম একটা উছিলা পেলেই আম্মাকে জ্বালাইতাম নানার বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য। নানার বাড়ি যাওয়ার দিনটি ছিল ছোটবেলার সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত। মনের ভিতর এক ধরনের নাচন শুরু হতো, সেদিন খুশিতে আর ভাত ই খাওয়া হতো না। নানার বাড়িতে গেলে দুইটা সুবিধা; স্কুলে যাওয়া লাগে না আর নানার বাড়ির গেইটের সামনেই বাজার। ছোটবেলায় বাজারে বাজারে ঘুরে বেড়ানোটা ছিল নেশার মতো। আমি সারাদিন বাজারে হাটতাম আর বাজারের ছেলেদের সাথে মার্বেল আর ডাংগুলি খেলতাম। বদ অভ্যাস আরো কিছু ছিল বৈকি! কাঁঠালগাছে উঠে কাঁচমিরকা দিয়ে ছোট ছোট ডেগা কাঠালগুলো পাকাইতাম, দুই-তিন কোষ খেয়ে কাঠালটা গাছে রেখেই নেমে পড়তাম। এই সুখ অবশ্য বেশিদিন কপালে জুটে নি! হাইস্কুলে উঠার পর একদিন মামার বাড়ি বেড়াতে গেলে আমাকে আর আমাদের বাড়ি আসতে দিলেন না। ভর্তি করিয়ে দিলেন মামাদের হাই স্কুলে। তখন মামাদের স্কুলে খুব কড়াকড়ি চলতো। পরীক্ষায় নাম্বার কম পাইলে, সিনেমা দেখতে গিয়ে ধরা পড়লে স্কুলের লাইব্রেরীতে নিয়া ইচ্ছামত বেতাইতো! বেতের বাড়িগুলো ছিল খুব জঘন্য কায়দায়! জালিব্যত দিয়ে ঠাস করে বাড়ি মারতো, তারপর কয়েক সেকেন্ড ব্যতটা হাতের উপর ধরে রাখতো, তারপর আস্তে করে উঠিয়ে আবার একই কায়দার বাড়ি। দুই তিনটা বেতের বাড়িতেই পিতাপোড়া দাগ। মামা গম্ভীর গলায় অন্য মাস্টারদের বলে দিতেন, “তার মতো সেনারে বেতানের উপর না রাখলে মানুষ হইতো না”। মামাকে আমি এখনো ভয় পাই। শুধুমাত্র মামা যখন পান চিবায়, তখন ভয় পাই না। পান খাওয়া মানুষ দেখলে আমার মন ভালো হয়ে যায়। আমার মায়ের পান খাওয়ার দৃশ্যও চমৎকার লাগে।

পান আর বরকামতার মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। পান চাষের জন্য অত্র অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন যায়গা হল বরকামতা। নানার বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি কামারখোলা যাওয়ার পথে সবসময়ই বরকামতার ভিতর দিয়ে আসা যাওয়া হতো। বরকামতার পাশেই কাঠের পুল। বিগত কয়েক দশক ধরে প্রশাসনিক বিন্যাসের কারনে বরকামতা যদিও দেবিদ্বারের সীমান্তে পড়ছে কিন্তু প্রাচীনকাল থেকেই বরকামতা, কাঠের পুল, ক্ষীরোদ নদী ইত্যাদি আমাদের ই অংশ, চান্দিনা অঞ্চলের গল্প। ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলোতে বরকামতাকে “চান্দিনার বরকামতা” নামেই পরিচয় করিয়ে দেয়া আছে। বরকামতার খ্যাতি হলো পানের বরজে, আসা যাওয়ার সময় প্রচুর পানের বরজ দেখতাম। একটু আধটু দাঁড়াইতাম, বরজের ভিতর চুঁকি দিতাম। অদ্ভুত রকমের শুনশান নীরব আর ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব থাকতো বরজের ভিতরে। তবে এখনো পান চাষ করেই বেঁচে আছে বরকামতার অধিকাংশ স্থানীয় লোকজন। প্রায় আড়াইশ বছর ধরে বরকামতায় পানের চাষ চলছে। এখানকার পানের বরজ নিয়ে মজার মজার কিছু পৌরাণিক বিশ্বাসের কথাও শোনা যায়। যেমন: তাদের পানের বরজে নারীদের প্রবেশ নিষেধ। বিশেষ করে যুবতী নারীরা পানের বরজে প্রবেশ করতে পারবে না, তারা বিশ্বাস করে যুবতীরা অশুদ্ধ হয়। যুবতীরা বরজে ঢুকলে পান ক্ষেত নষ্ট হয়। যদি কোন যুবতী নারী জরুরী প্রয়োজনে ঢুকেও পড়ে, পান ছিঁড়তে পারবে না। আরেকটি বিষয়, বরকামতার পান চাষীরা পানকে বলে হুনাই। দুর্গা দেবীকে বলে হুনাই দেবী। দুর্গা পুজার নবমীর দিনে তারা করে হুনাই পূজা। এরা হুনাই দেবীর চরম ভক্ত!

“লাউয়ের আগা ভেরনের মাতি, হুনায় করে রাতারাতি”
“হুনাই মাগো উষা বালি ধুপো ধাপে পূজা করি”
“পুজা করি তোমারে বর দিবা আমারে”

তারা বিশ্বাস করে এই গাঁথাগুলি পাঠ করলে হুনাই দেবী পান ক্ষেতে আসবে এবং তাদের পানের ফলন ভালো হবে। তাদের এসব পৌরাণিক বিশ্বাস এবং গাঁথাগুলি এইদিকে যেমন ইন্টারেস্টিং, অন্যদিকে তাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন পশ্চাদপদ সমাজব্যবস্থা নির্দেশ করে। কিন্তু রাজধানী বরকামতা এমন ছিল না। বরকামতার সাথে জ্ঞানের একটা যোগসূত্র আছে, তবে সেটা আরো অনেক আগে। তৎকালীন এশিয়ার জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দু ছিল কোটবাড়ির আনন্দ বিহার। আনন্দ বিহার ছিল কোটবাড়ির ৩৫ টি শিক্ষাকেন্দ্রের সামগ্রিক রুপ। আনন্দ বিহার তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা পেতো। প্রশাসনিক কারনেই অত্র অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হতো সমতট রাজ্যের রাজধানী বরকামতা থেকে, দেখভাল চলতো ৪ হাজার বৌদ্ধ ছাত্রের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান আনন্দ বিহার। যখন রাজধানী ছিল, তখন বরকামতার নাম ছিল “জয়কর্মান্তবসাক”। অথচ এই বরকামতা গ্রামে এখন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় তো দূরের কথা, একটা হাইস্কুলও নাই। বরকামতার অধিকাংশ মানুষই বরকামতা বা কাঠের পুল এলাকার এই অতীত গৌরবের কথা জানে না। অনেকেই জানে না যে, আজ থেকে প্রায় বার’শ বছর পূর্বে আশেপাশের প্রায় পাঁচশত মাইল এলাকার শাসন চলত বর্তমানে মৃতপ্রায় কাঠের পুল এলাকা থেকে, আনুমানিক ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শতক পর্যন্ত।
প্রাচীনকাল থেকেই পূর্ব ও দক্ষিন বঙ্গের মধ্যে বরকামতা ছিল সবচেয়ে রাজনৈতিক সচেতন অঞ্চল। বিধ্বংস ব্রিটিশবিরোধী যুদ্ধ হয়েছে, পাকিস্তানি সৈন্যদের ট্যাংক উড়িয়ে দেয়া হয়েছে কাঠের পুল থেকে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এখানেই গড়ে উঠেছিল অভয়াশ্রম। অভয়াশ্রম চালাত গান্ধীজীর পালিতা কন্যা চিরকুমারী অন্তুস সালাম। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে বেশিরভাগ কংগ্রেস, কমিউনিস্ট, ব্রিটিশবিরোধী সংগঠক এবং বিপ্লবী নেতাদের আনাগোনা বেশি ছিল বরকামতার কাঠের পুল এলাকায়। কংগ্রেস নেতা নরেন্দ্র চন্দ্র চৌধুরী, তারিক কর, চিত্ত চক্রবর্তীর মতো বিপ্লবী নেতাদের আবাসস্থল ছিল বরকামতায়। তাদের বিপ্লবী স্বদেশী গ্রুপটি একবার “ষ্ট্যাট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া” (বর্তমানে পুবালী ব্যাংক) লুণ্ঠন করে সেগুলো গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তবে মহাত্মা গান্ধী সহিংস পথে যাননি, তিনি বরকামতায় এসে অহিংস পথে বিপ্লবীদের সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি ১৯৩৮ সালে চান্দিনা তাত বস্ত্র শিল্প কারখানা পরিদর্শন শেষে চান্দিনা বাজারে (বর্তমান চান্দিনা গরু বাজার) কংগ্রেস দলের আয়োজনে এক জনসভায় বক্তব্য রেখেছিলেন। গান্ধীজী মঞ্চে উঠে মাত্র দুই মিনিট বক্তব্যে দেন। চান্দিনা বাজারের জনসভায় তার উল্লেখযোগ্য উক্তি “হিন্দু মুসলিম ভাই হো, এক হো, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদকো খতম করো”।

মহাত্মা গান্ধীর নামটি আরেকটি কারনে এই কাঠের পুলের সাথে জড়িত। তিনি এই এলাকা পরিদর্শনকালে বিশ্বখ্যাত খাদি বা খদ্দর কাপড়ের নামকরনের করেন। খাদে বা গর্তে বসে এই কাপড় বুনন হতো বলে এর নাম খাদি বা খদ্দর। তখন ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলনে পুরা ভারতবর্ষ গরম। তিনি খাদি কাপড়ের আরেকটি নাম দেন “স্বদেশী কাপড়”, সেটা ১৯২১ সালে। গান্ধীজির উদ্দেশ্য ছিল দেশপ্রেম, সেজন্য তিনি “মোটা কাপড়, মোটা ভাত” ব্যবহারের ডাক দিয়ে বিদেশী পন্য বর্জনের আহবান জানিয়েছিলেন এই বরকামতা থেকেই। এখনো বরকামতার প্রায় ৫০ টি পরিবার খাদির ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। খাদি কাপড়ের অগ্রদূত ছিলেন শৈলেন্দ্রনাথ গুহ, তিনি কাঠের পুলের পাশেই চাঁন্দারপাড়ে বসে খাদিকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করে তুলেন। যদিও তার বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়ায়, কিন্তু সারাজীবন ব্যয় করে করেছেন বরকামতায় বসে, খাদিকে জনপ্রিয় করার কাজে। তিনিই খাদির জনক। চান্দিনার আরো একজন মনিষীর কথা না বললেই নয়, তিনিও ওই সময়েই চান্দিনায় জন্মগ্রহণকারী। তার বাড়ি অবশ্য বরকামতায় নয়, কৈলাইন গ্রামে। তিনি প্রাচীন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মহাস্থবির শীল ভদ্র ভীখু। জ্ঞানেগুনে এই ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে যাওয়া কুমিল্লার আর কোন ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। তিনি শত শত বই লিখেছিলেন। তৎকালীন সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের কোন ব্যক্তিই এতো বই লিখতে পারেননি। তার দর্শনবিষয়ক একটি বইয়ের নাম “আর্য-বুদ্ধভূমি ব্যাখ্যান”।

কাঠের পুলের পাশেই চান্দিনার থানা রোড। এই রোডটি সকলেরই সুপরিচিত। থানা রোড দিয়ে কাঠের পুল পার হয়ে, বরকামতার ভিতর আমাদের আসা যাওয়া হতো। বর্তমানে যদিও এটি থানা রোড নামে পরিচিত, তবে এই রাস্তাটি কিন্তু ঐতিহাসিক। কাঠের পুল থেকে শুরু হয়ে চান্দিনা পালকি সিনেমা হলে গিয়ে শেষ হওয়া এই বাকা পুরাতন রাস্তাটিই শেরশাহ্’র শাসনামলের সেই গ্র্যাদন্ড ট্রাং রোড। প্রাচীনকালে এটি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে শুরু হয়ে চান্দিনার ভিতর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া হয়ে পাকিস্তানের পেশাওয়ারের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের কাবুল পর্যন্ত পৌছায়। এই সড়কটি এখন সরকারি কাগজপত্রে চান্দিনা “থানা রোড” নামে পরিচিত কিন্তু আন্তর্জাতিক গুগল ম্যাপে এটি Grand Trunk Road হিসেবেই চিহ্নিত আছে।

ছোটবেলায় শহর, গাড়ি দেখতে পেতাম না। আমার জন্য চান্দিনা ই ছিল শহর এবং কাঠের পুল ছিল গাড়ি দেখার যায়গা। কাঠের পুল পার হওয়ার সময় গাড়িগুলো পাশ দিয়ে সাই সাই করে চলে যেতো, বিষয়টা রোমাঞ্চকর লাগতো আমার কাছে। গাড়ীর ভিতরের মানুষগুলোকেও দেখতাম, তাদেরকে খুব হিংসা হতো। এখনো আমি বরকামতা দিয়ে চলাচল করি। যদিও নিমসার বা কোরপাই দিয়ে আবিদপুর যাওয়া বেশি সহজ, বেশি তাড়াহুড়া না থাকলে আমি এখনো বরকামতা দিয়েই যাই। আসা যাওয়ার পথে মাঝেমধ্যে কাঠের পুল ও বরকামতা বাজারের চায়ের দোকানগুলোতে বসে চা-টা খাই। বরকামতার স্থানীয় লোক দু-একজনকে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাস করি শৈলেন্দ্রনাথের নাম শুনেছেন? উত্তর দেয় না, নির্বিকার থাকে! তবে মহাত্মা গান্ধীর গল্প তারা বলতে পারে কারন মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিবিজড়িত “সালাম বাড়ি” এখনো বরকামতায় আছে। ব্যক্তিগতভাবে এই এলাকাগুলো আমার আবেগপ্রবণ এলাকা। আর এমনিতেও বরকামতা, কাঠের পুল চান্দিনার ঐতিহ্য। ঐতিহ্যের চেয়ে বড় কোন উত্তরাধিকার নেই।

নুরুল ইসলাম
উপসহকারী পরিচালক,
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), চট্টগ্রাম।
পিতা- মোঃ সুজাত আলী মাস্টার।
গ্রাম- কামারখোলা, ইউনিয়ন- মাইজখার, চান্দিনা।

Exit mobile version